অস্টিও আর্থ্রাইটিস প্রতিরোধ করি

মানুষের শরীরে হাড়গুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকে বিশেষ গিঁটে বা জোড়ায়। এই জোড়গুলো মসৃণভাবে নড়াচড়া করতে পারে কারণ কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি হাড়ের দুই প্রান্তে সুরক্ষা দিতে আবরণ তৈরি করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বা বিভিন্ন কারণে এই কার্টিলেজ ক্ষয় হতে থাকে। তখনই তৈরি হয় “হাড় জোড়ার গিটে ব্যথা” বা অস্টিওআর্থ্রাইটিস। এটি পৃথিবীর অন্যতম সাধারণ দীর্ঘমেয়াদি জয়েন্ট রোগ, বিশেষ করে ৪০ বছরের পরে।
হাড় জোড়া গিটে ব্যথা কী?
যখন জোড়ে থাকা কার্টিলেজ ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যায়, তখন হাড়ের এক প্রান্ত আরেক প্রান্তের খুব কাছে চলে আসে। এতে হাড় ঘষা লেগে ব্যথা, ফোলা, শক্তভাব, নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা ও বিকৃতি দেখা দেয়। এটি প্রগ্রেসিভ, অর্থাৎ সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
হাড় জোড়া গিটে ব্যথার কারণ ঃ অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণ একাধিক। এর মধ্যে কিছু প্রতিরোধযোগ্য, কিছু নয়।
১) বয়স বৃদ্ধি- বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ের তরুণাস্থি স্বাভাবিকভাবেই ক্ষয়ে যেতে থাকে।
২) অতিরিক্ত ওজন- ওজন বেশি হলে হাঁটু, কোমর ও মেরুদন্ডের ওপর চাপ অনেক বেড়ে যায়। প্রতি ১ কেজি অতিরিক্ত ওজন হাঁটুতে প্রায় ৩-৪ কেজির সমান অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে।
৩) জেনেটিক বা বংশগত কারণ- পরিবারে থাকলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
৪) পূর্বের জোড়ে আঘাত- খেলাধুলার ইনজুরি, দুর্ঘটনা, লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া, মেনিস্কাস ইনজুরি ইত্যাদি পরবর্তী সময়ে অস্টিওআর্থ্রাইটিস বাড়ায়।
৫) অতিরিক্ত ব্যবহার-
● কায়িক পরিশ্রম,
● সিঁড়ি বেশি ওঠানামা,
● দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কাজ,
● ভারী ওজন বহন। এগুলো হাঁটু/কোমর নষ্ট করতে পারে।
৬) জোড়ের গঠনগত সমস্যা- বাঁকা পা, নক নী, জন্মগত রোগ ইত্যাদি।
৭) প্রদাহজনিত রোগ – সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের সময় মতো চিকিৎসা না করলে গিটে ক্ষয় বাড়াতে পারে।
লক্ষণ -অস্টিওআর্থ্রাইটিসের লক্ষণ ধীরে ধীরে শুরু হয়।
১) ব্যথা-সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। হাঁটা, দাঁড়ানো, সিঁড়ি ওঠা বা ওজন দিলে বাড়ে তবে বিশ্রামে কিছুটা কমে
২) গিট শক্ত হয়ে যাওয়া ● সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ১৫-৩০ মিনিটের জন্য, ● দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা বা বিশ্রামের পরে বেশি হয়
৩) গিটে ফোলা
৪) চলাফেরায় শব্দ- চলতে গেলে কট কট শব্দ।
৫) নড়াচড়ার সীমাবদ্ধতা- ● হাঁটু ভাঁজ করতে অসুবিধা ● পা মোড়া দিয়ে বসলে কষ্ট হয় ● কোমর নড়াতে ব্যথা
৬) বিকৃতি- রোগ বাড়লে হাঁটু ইংরেজি ‘ও’ আকৃতির বা ‘এক্স’ আকৃতির হয়ে যেতে পারে।
৭) চলাফেরা কমে যাওয়া ও দৈনন্দিন কাজে অসুবিধা- সিঁড়ি ওঠা, লম্বা সময় হাঁটা, নামাজে সিজদা এগুলো সব কঠিন হয়ে যায়।
পরীক্ষা- রোগ নির্ণয়ের প্রধান উপায় হলো ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা ও এক্স-রে।
১) এক্স-রে- জয়েন্টের স্পেস কমে যাওয়া, ছোট হাড় তৈরী হওয়া, তরুনাস্থির নীচে স্কেøরোসিস, হাড়ে কাঁটা তৈরী হওয়া এগুলো অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ক্লাসিক লক্ষণ।
২) এমআরআই (যখন দরকার)- কার্টিলেজ ক্ষয়, মেনিস্কাস/লিগামেন্ট ইনজুরি, নরম টিস্যুর সমস্যা। শুধু গুরুতর ক্ষেত্রে বা অস্ত্রোপচারের আগে এমআরআই করা হয়।
৩) রক্ত পরীক্ষা (সাধারণত অপ্রয়োজনীয়) এই রোগে রক্ত পরীক্ষায় বিশেষ কিছু পরিবর্তন থাকে না। অন্য রোগ সন্দেহ হলে যেমন- রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সন্দেহ হলে- আরএফ, এন্টি সিসিপি, ইএসআর ও সিআরাপি করা হয়।
নিয়ন্ত্রণ ঃ অস্টিওআর্থ্রাইটিস সম্পূর্ণ সারানো না গেলেও নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব। চিকিৎসা কয়েক ভাগে করা হয়-
নন-মেডিকেল বা জীবনযাপনভিত্তিক চিকিৎসা-
১) ওজন কমানো -এটি সবচেয়ে কার্যকর উপায়। ৫-১০% ওজন কমালেও ব্যথা অনেক কমে।
২) ব্যায়াম -শরীরচর্চা কার্টিলেজে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, পেশি শক্ত করে। উপযোগী ব্যায়াম- ● কায়াকিং/স্টেশনারি সাইক্লিং, ● হাঁটা, ● জল-ব্যায়াম বা একোয়া থেরাপী, ● কোড্রিসেপস্ স্ট্রেন্থেনিং, ● হেমিস্ট্রিং স্ট্রেচিং। যে ব্যায়ামে বেশি ঝাঁকুনি লাগে (দৌড়, ফুটবল) সেগুলো এড়ানো প্রয়োজন।
৩) বিশ্রাম এবং জোড় সুরক্ষা- লম্বা সময় দাঁড়ানো কমানো, ভারী জিনিস না তোলা যাবে না, সিঁড়ি কম ওঠা।
৪) উষ্ণ সেঁক / ঠান্ডা সেঁক -● ব্যথা হলে ঠান্ডা সেঁক, ● শক্তভাব হলে গরম সেঁক
৫) ব্রেস বা সাপোট- নী ব্রেস, পেটেলা স্ট্রেপ, সু ইনসোল চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যাবহার করা যায়।
ব্যথা কমাতে আর হাড় ক্ষয় রোধে ওষুধ ব্যাবহার করতে হয়। তবে,ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ নেওয়া ঠিক না।
১) ব্যথানাশক- প্যারাসিটামল (মৃদু ব্যথায়), বেশী ব্যথায় অন্য এনএসএইড তবে কিডনি/হার্ট রোগে সাবধানে নিতে হবে।
২) টপিকাল ব্যথা নাশক মলম- ডাইক্লোফেনাক বা কিটোপ্রোফেন হাঁটু ব্যথায় খুব কার্যকর ও তুলনামূলক নিরাপদ।
৩) গ্লুকোজামিন ও কন্ড্রয়েটিন- বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সীমিত, কিন্তু কিছু রোগীর উপকার হয়।
৪) ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম- হাড় শক্ত রাখতে প্রয়োজন।
ইঞ্জেকশন চিকিৎসা ১) স্টেরয়েড ইনজেকশন- ব্যথা ও প্রদাহ দ্রুত কমায়, ৩-৪ মাসে একবার নেয়া যায, বারবার দেওয়া ঠিক না।
২) হায়ালুরোনিক অ্যাসিড – জোড়ে তৈলাক্ত ভাব ফিরিয়ে আনে, ব্যথা কমায়, কিছু রোগীর খুব উপকার হয়।
অস্ত্রোপচার- যখন ব্যথা অসহনীয় হয়, হাঁটা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তখন ১) আথ্রোস্কোপিক ডিব্রাইডমেন্ট করলে প্রাথমিক অবস্থায় কিছু রোগীর উপকার। ২) হাই টিবিয়াল অস্টিওটমি- হাঁটুর গঠন ঠিক করে, তরুণ রোগীদের জন্য ভাল। ৩) টোটাল নী বা হিপ রিপ্লেসমেন্ট- উন্নত চিকিৎসা, ব্যথামুক্ত স্বাভাবিক হাঁটা সম্ভব, কিন্তু খরচ বেশি, অপারেশনের ঝুঁকিও থাকে।
প্রতিরোধ ঃ অস্টিওআর্থ্রাইটিস শুরু হওয়ার আগেই কিছু নিয়ম মেনে চললে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যায়-
✔ওজন নিয়ন্ত্রণ,
✔ নিয়মিত ব্যায়াম,
✔পুষ্টিকর খাবার (ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম),
✔ চলাফেরার সময় সঠিক ভঙ্গি,
✔ একটানা বসে না থাকা,
✔খেলাধুলায় সঠিক সুরক্ষা,
✔ধূমপান পরিহার,
✔চিনি ও অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার কমানো।
প্রতিকার ঃ হোম ম্যানেজমেন্ট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা-
১) খাদ্যাভ্যাস ● ওমেগা-৩ (মাছ, বাদাম, ফ্ল্যাক্সসিড), ● অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (সবুজ শাক, ফল), ● কম ক্যালরির খাবার, ● ফাস্টফুড, অতিরিক্ত লবণ কমানো।
২) দৈনন্দিন টিপস- ● বসার সময় হাঁটু ভাঁজ কম করা, ● নিচু হয়ে ফ্লোরে বসা এড়ানো, ● নামাজে সেজদা করতে সমস্যা হলে চেয়ার ব্যবহার, ● লম্বা সময় হাঁটলে মাঝে মাঝে বিরতি।
৩) মানসিক সুস্থতা- দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা উদ্বেগ বাড়ায়। ধ্যান, হালকা মেডিটেশন সহায়ক।
৪) ফিজিওথেরাপি-
● আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি
● টেনস্
● ব্যালান্স ট্রেনিং
এগুলো ব্যথা কমাতে কার্যকর।
সার সংক্ষেপ ঃ
হাড় জোড়া গিটে ব্যথা (অস্টিওআর্থ্রাইটিস) একটি সাধারণ, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। যদিও এটি পুরোপুরি সারানো যায় না, সঠিক জীবনযাপন, ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ঔষধ ও প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রোগী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। আর প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে ক্ষয় অনেকটাই ধীর করা যায়।

Related Posts

en_GB