ঐক্য-অনৈক্যের রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সর্বাত্মক প্রতিরোধে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শীর্ষ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে সম্মুখসারিতে না থাকলেও গত দেড় দশকে সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের অবদান নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য; দীর্ঘ আন্দোলনে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিপীড়নের অভিজ্ঞতায় বিরোধী দলগুলো পরস্পরের মিত্র হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ছাত্রনেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল এনসিপি কম সময়ের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে হাজির হয়েছে। নির্বাচন ও সংবিধান প্রশ্নে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো যার যার অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছে। আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়েই শুধু নয়; দেশের শাসন কাঠামো সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও প্রবণতা সুস্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দু’দফা বৈঠকে নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রধান সুপারিশগুলোর বিষয়ে সরাসরি আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। সমকাল জানাচ্ছে, ‘সাধারণ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন ও গণভোট এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনে শক্ত আপত্তি আছে বিএনপির। তারা এ বিষয়ে কোনো আপসও করবে না (২০.০৪.২৫)। দল ও সরকারপ্রধান এক ব্যক্তি এবং এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না– এই দুটি বিষয়েও একমত নয় বিএনপি। জানা গেছে, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে নতুন প্রস্তাব আসে– এক ব্যক্তি মাঝখানে বিরতি দিয়ে সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। প্রস্তাবটি নিয়ে পরে মতামত দিতে চেয়েছে বিএনপি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির মতের সরাসরি বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছে এনসিপি। তাদের বিবেচনায় বর্তমান ক্ষমতা কাঠামো এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। শেখ হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার এটি অন্যতম কারণ। মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন দিলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। মৌলিক সংস্কার বলতে এনসিপি সংস্কার কমিশনের প্রধান প্রস্তাবগুলোই সামনে নিয়ে এসেছে।

২.
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে সরকার আবারও জানিয়েছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সংস্কার কমিটির প্রস্তাবিত প্রধান কোনো সংস্কার প্রস্তাবনাতেই তারা একমত নন। বোঝাই যাচ্ছে, ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রশ্নে বিএনপি রাজি নয়; বরং আইন ও শৃঙ্খলাজনিত কিছু নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারের পরপরই নির্বাচন আয়োজনে আগ্রহী। লক্ষণীয়, নবগঠিত এনসিপি ছাড়া পুরোনো রাজনৈতিক দলের প্রায় সবাই ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরিতে মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে উচ্চকিত নয়। ন্যূনতম সংস্কার শেষে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির ব্যাপারে ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দল, শীর্ষ বাম দলগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করতে শুরু করেছে বিএনপি। এ ব্যাপারে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

৩.
স্পষ্টতই সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে চাইছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন হলে বিএনপির জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি বলেই তাদের এই ভূমিকা। অন্যদিকে প্রস্তাবিত প্রধান সংস্কারগুলোর লক্ষ্য ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে একব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে দূরে রাখা। এই চেক অ্যান্ড ব্যালান্স বিএনপির পছন্দ হচ্ছে না। তাহলে কি আমরা বলতে পারি– বিএনপি আগের শাসন পদ্ধতির কোনো গুণগত পরিবর্তন চাইছে না? চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা কর্তৃত্ববাদের অবসান। ক্ষমতার ভারসাম্য না আনলে তা আদৌ সম্ভবপর নয়।
লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মৌলিক সংস্কার বা ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে সকল রাজনৈতিক দল সরব না হলেও আওয়ামী লীগ প্রশ্নে সকলে উচ্চকিত এবং তাদের পুনর্বাসনের তীব্র বিরোধী। এটি একদিক থেকে যথার্থ বটে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব যে দম্ভ ও অগণতান্ত্রিক আচরণ দেখিয়েছেন, তার খেসারত দিতে হয়েছে জাতিকে বহু প্রাণের বিনিময়ে। এর জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আসতে হবে; তার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক হবে? ২০০১ ও ২০০৮ সালের সর্বশেষ স্বীকৃত দুই নির্বাচনে মোটামুটি ৪০ শতাংশ করে ভোট পেয়ে যথাক্রমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে বিজয়ী হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করলেও তাদের কর্মী-ভোটার সংখ্যা এখনও প্রচুর। এদের সবাই অপরাধের সঙ্গে জড়িতও নন। কাজেই তাদেরকে নির্বাচনের বাইরে রাখা সংগত হবে না। এই বাস্তবতার পরও সব কয়টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চাইছে নিশ্চিতভাবে এই বিবেচনায়– ভোটের বাজারে আওয়ামী ভোটের ভাগ গোলায় তোলার জন্য।

সম্পর্কিত পোস্ট

bn_BD