জুলাইযোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির ওপর প্রাণঘাতী হামলাতেও বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী পরস্পরকে যেভাবে দোষারোপ করছে, তাতে উদ্বিগ্ন সরকার। নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনমুখী দলগুলোকে পারস্পরিক বিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে সরকারপ্রধানের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে দলগুলো। দলগুলোর নেতারা হাদির পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বৈঠকে বলেছেন, পরস্পরকে দোষারোপ থেকে বিরত থাকতে হবে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, দলীয় স্বার্থে একে অন্যকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছি। এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, দলগুলোর টানাপোড়েনে আ
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। যদিও যমুনার বৈঠকের পরও পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো ভুয়া ফটোকার্ড এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) তৈরি ছবির বরাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, হাদির ওপর গুলিবর্ষণে জামায়াত-শিবির দায়ী বলে পুলিশ জানিয়েছে। সন্দেহভাজন গুলিবর্ষণকারী ছাত্রশিবির নেতা ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমের সঙ্গে চা খাওয়ার ছবি এসেছে। যদিও ফ্যাক্টচেকে বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর রিজভী দুঃখ প্রকাশ করেন।
তবে এর আগেই জামায়াত রিজভীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে ক্ষমা চাইতে বলে। দুই দলের নেতাকর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে বিষোদ্গার করছেন। হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সমাবেশ থেকে দলগুলো পরস্পরকে আক্রমণ করেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দলগুলো এককাতারে থাকলেও নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই পারস্পরিক দোষারোপ বাড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় হামলা-মারামারির ঘটনা ঘটছে। শুক্রবার দুপুরে নির্বাচনী জনসংযোগে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হাদিকে গুলি করার পর প্রার্থীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
হাদির ওপর সন্দেহভাজন গুলিবর্ষণকারী ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খানের ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য সামনে আসার পর ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে আওয়ামী লীগ। এ পরিস্থিতিতে গতকাল যমুনায় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধান উপদেষ্টা।
নির্বাচন ঠেকাতে প্রশিক্ষিত শুটার নেমেছে
ক্ষমতাচ্যুত শক্তি নির্বাচন বানচাল করতে চাইছে বলে দলগুলোকে সতর্ক করেছেন সরকারপ্রধান। হাদির ওপর হামলার ঘটনাটি সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এর পেছনে বিরাট শক্তি কাজ করছে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচন হতে না দেওয়া। এই আক্রমণটি খুবই ‘সিম্বলিক’।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। তারা প্রশিক্ষিত শুটার নিয়ে মাঠে নেমেছে।
দলগুলোকেও শক্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়, নির্বাচনের সব আয়োজন ভেস্তে দিতে চায়। এগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে নির্বাচনের আগে যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, তা থেকে সরে আসতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে যেন দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে না পড়ে, খেয়াল রাখতে হবে। রাজনৈতিক বক্তব্য থাকবে, কিন্তু কাউকে শত্রু ভাবা বা আক্রমণ করার সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে। নির্বাচনী উত্তেজনা যেন নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি শুরু হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়েছে। আপনাদের শুধু দলীয় স্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থের বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে।
নেতারা যা বললেন
সালাহউদ্দিন বলেন, এ পরিস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যে কোনো অবস্থাতেই পরস্পরের দোষারোপ থেকে বিরত থাকতে হবে। যতই রাজনৈতিক বক্তব্যের বিরোধিতা থাকুক না কেন, জাতির স্বার্থে এবং জুলাইয়ের স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতেই হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করার পরামর্শ দেন বিএনপির এই নেতা।
গোলাম পরওয়ার বলেন, নানা বক্তব্য একে অন্যকে দোষারোপ করার প্রবণতা বাড়িয়েছে। যার ফলে আমাদের বিরোধীরা সুযোগ পেয়েছে। ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে আমরা একে অন্যকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছি। জাতিকে বিভক্ত করে এমন কথা আমরা কেন বলব? আমাদের আগের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
নাহিদ ইসলাম জুলাই অভ্যুত্থানবিরোধী প্রচার প্রসঙ্গে বলেন, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বয়ান তৈরি করা হচ্ছে, যাতে মনে হয় যারা অভ্যুত্থান করেছে, তারা অপরাধ করেছে।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে ‘নরমালাইজড’ করার চেষ্টা চলছে দাবি করে নাহিদ ইসলাম বলেন, টকশোতে তারা নিয়মিত অংশ নিচ্ছে, প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় বৈঠক করছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মিলিত হচ্ছে এবং আদালত প্রাঙ্গণে স্লোগান দিচ্ছে। বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী বেশে থাকা আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকারীদের থামাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। জুলাইকে সবাই মিলে ধারণ করতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের অনৈক্যকে পরাজয় হিসেবে দেখছে। তারা ভারতে বসে যা ইচ্ছা তা-ই করছে, আর আমরা কিছুই করতে পারছি না।
নিজেদের জন্য বিশেষ কোনো নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই মন্তব্য করেন নাহিদ। বৈঠকে থাকা এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারলে কোনো নিরাপত্তাই কাজে আসবে না।
বৈঠকে আরও ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। যমুনার বাইরে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, হাদিকে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ভারতের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। শেখ হাসিনার মতো গণহত্যাকারীকে আশ্রয় দিয়ে ভারত সরকার নৈতিক অপরাধ করেছে। এখন তারা আওয়ামী লীগকে সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
