বরগুনার তালতলীর খোট্টার চর ও পায়রা নদীর মোহনা ঘিরে গড়ে ওঠা কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উপকূলীয় প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূচনা করেছে। একসময় সবুজে মোড়া এই জনপদ আজ ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগোচ্ছে-মরছে গাছ, হারিয়ে যাচ্ছে মাছ, আর জীবনযুদ্ধে হেরে পথে বসছেন হাজারো জেলে ও কৃষক পরিবার।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর থেকেই নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে গরম ও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। এর প্রভাবে উপকূলীয় গাছপালার ক্ষতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নারিকেল, সুপারি, তালসহ শত শত গাছ ফল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বহু গাছ দাঁড়িয়ে আছে মৃত কাঠের মতো।
নিশানবাড়িয়ার কৃষক আবদুস সালাম মাতুব্বর বললেন, আগে বছরে হাজার হাজার টাকার নারিকেল-সুপারি বিক্রি করতেন। এখন গাছের ডালে ফুল নেই, ফলে তো দূরের কথা। তাঁর আশঙ্কা-কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো এলাকা গাছশূন্য হয়ে পড়বে।
ইলিশের জন্য বিখ্যাত পায়রা নদী এখন একরকম মাছশূন্য। জেলেদের দাবি-বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গরম পানি ও রাসায়নিক বর্জ্য নদীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা এবং অক্সিজেনস্তর নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে ইলিশসহ নানা প্রজাতির মাছ এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছে। এতে নদীনির্ভর হাজারো জেলে পরিবার গভীর সংকটে পড়েছে।
জয়ালভাঙার জেলে ইউনুস আলী জানালেন, একসময় এক রাতে কয়েক হাজার টাকার মাছ ধরতেন। এখন তিন-চার দিন নদীতে নেমেও জালে মাছ ওঠে না। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর আগে তালতলী ও খোট্টার চর অঞ্চলে কৃষি ও মাছ শিকার ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। এখন দুই ক্ষেত্রেই ধস নামায় বহু পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। কেউ চলে যাচ্ছেন অন্য জেলায়, কেউ বাধ্য হচ্ছেন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়। উপকূলের সমাজজীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তার ঘনছায়া।
স্থানীয় চিকিৎসকেরা জানান, ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট,পানিবাহিত রোগসহ নানা জটিলতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিশুদ্ধ পানির সংকটও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দূষণের বৃত্তে সবচেয়ে বেশি ভুগছে শিশু ও বয়স্করা।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা বরগুনা জেলা শাখার সদস্য সচিব সাংবাদিক মুশফিক আরিফ বলেন, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই, গরম পানি ও রাসায়নিক বর্জ্য জমি, নদী ও বাতাসে ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করছে। তাদের মতে, এখনই কঠোর নজরদারি ও বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না নিলে পায়রার এই অংশ খুব দ্রুত মৃত নদীতে পরিণত হবে।
তিনি আরো মানুষের অভিযোগ করে বলেন, বছরের পর বছর ধরে এই বিপর্যয়ের কথা জানালেও কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের তদারকি প্রায় নেই বললেই চলে। উন্নয়নের সুবিধা পাচ্ছে অন্য অঞ্চল, কিন্তু তার মূল মূল্য দিচ্ছে উপকূলের সাধারণ মানুষ।
২০১৭ সালে কাজ শুরু করে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি চালু হওয়া ৩০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে, যা পাওয়ার চায়না রিসোর্স ও বাংলাদেশের আইসোটেক গ্রুপের যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত। প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকেই জমি অধিগ্রহণ, নদী দূষণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং স্থানীয় জীবিকার সংকট নিয়ে বিতর্ক থামেনি।
তালতলীর মানুষের কণ্ঠে এখন একটাই দাবি-উন্নয়ন চাই, কিন্তু জীবনের বিনিময়ে নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন প্রয়োজন, তেমনি এই উপকূলীয় অঞ্চল, নদী, গাছপালা, কৃষি আর অসংখ্য জেলে-কৃষকের জীবনও রক্ষা করতে হবে। নয়তো অচিরেই পুরো অঞ্চল ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে-যার দায় কেউ এড়াতে পারবে না।
