মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে। মনের মাধুরি মিশিয়ে স্বপ্ন বোনে। স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় ছুটে চলে অবিরাম। ছুটে চলার এ খেলা মহাকালের। মানুষের যেমনি স্বপ্নের অন্ত নেই, তেমনি স্বপ্ন ভাঙার গল্পের কোন কমতি নেই। আপনার হয়তো স্বপ্ন ছিল- ছাত্র জীবনে খুব চমকপ্রদ রেজাল্ট করবেন, আপনার পদচারণায় ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস মুখরিত হবে। বিসিএস ক্যাডার হবেন, না হয় হবেন উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তা। হবেন স্বনামধন্য প্রকৌশলী কিংবা চিকিৎসক। হয়তো হবেন কালজয়ী কবি, সহিত্যিক, স্কলার বা ফিলোসোফার। নয়তো হবেন জগৎজোড়া কোন বিজ্ঞানি বা স্থপতি। হবেন জাজ কিংবা ব্যারিষ্টার। নাহয় হবেন নামকরা কোন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী। হবেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ। পাবেন রাষ্ট্র পরিচালার কোন বিশেষ দায়িত্ব। যা সমাজ, রাষ্ট্র বা বিশ্বদরবারে আপনাকে করবে গৌরবান্বিত।
কিন্তু এর কোনটিই আপনি হতে পারেননি। স্বপ্ন ভেঙ্গেছে আপনার! স্বাদ ও সাধ্যের সমন্বয় না ঘটানো আপনি নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিচ্ছেন। হতাশার বিষমাখা গল্প আপনাকে অবিরত ক্ষত-বিক্ষত করছে। তবে আপনি যদি শুধুমাত্র একজন শিক্ষক হতে পারেন- তবে এ হতাশা বা স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প আপনার নয়। বরং সেই ভাঙ্গা স্বপ্নের ধ্বংশ স্তুপে দাড়িয়েই গড়ে তুলতে পারেন স্বপ্ন পূরণের এক সুবিশাল ইমারত। মানুষ গাড়ার এ পেশায় নিজেকে শামিল করা মানে- আপনি সকল পেশার স্রষ্টা। জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা। আশা-ভরসা আর প্রেরণার বাতিঘর। আপনার হাতেই রয়েছে আগামীর স্বদেশ এবং এক সম্ভাবনাময় জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। শুরু হতে চলেছে নতুন স্বপ্ন বোনা আর অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের এক সুবর্ণ সুযোগ।
সেই স্বপ্ন পূরণের গল্প রচনায় আপনাকে হতে হবে দক্ষ ও সুনিপুণ কারিগর। হতে হবে বিচক্ষণ ও বিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী। জ্ঞানে-গুনে, চলনে-বলনে, পোষাকে-আসাকে আপনি হবেন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। চেতনায় ধারণ করবেন দেশপ্রেম। বিচার বিশ্লেষণে হবেন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। নীতি-নৈতিকতা, সততা-আদর্শে আপনি আপসহীন। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সদা অবিচল। মানবিক গুণাবলী লালনে আপনি হবেন- বিনয়ী, উদার, আন্তরিক ও সৎকর্মশীল। শৈল্পিক ভূষণে হবেন- নান্দনিক, রুচিশীল ও সৃষ্টিশীল। হবেন- সময়নিষ্ঠ, অধ্যাবসায়ী ও ধার্মিক। মোহ আর কুসংস্কার থেকে আপনি সদা মুক্ত।
সত্যি বলতে আপনি আপনার অজান্তেই এ সকল গুণাবলী সযত্নে লালন করে চলছেন। আপনার নান্দনিক ছোঁয়ায় রচিত হচ্ছে স্বপ্ন পূরণের সাফল্যগাঁথা শতসহস্র কাব্য। সাফল্যগাঁথা সেই কাব্যই হতে পারে কালজয়ী মহাকাব্য। যদি আপনি আপনার ক্লাস নামক কারখানাকে করতে পারেন প্রানবন্ত। যদি শিক্ষার্থী নামক সেরা উপকরণগুলো কে জয়ের নেশায় করতে পারেন উজ্জীবিত। চেহারা পড়ে তাদেরকে বুঝতে সক্ষম হন। নিজ গুণে আপন করে তাদের হৃদয় দখল করতে পারেন। যে কোন ধরনের শারীরিক ও মানষিক শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে প্রশান্তির পরশ বুলাতে পারেন। স্বপ্ন দেখাতে পারেন। স্বপ্ন জয়ের পথ বাতলে দিতে পারেন। তাদের সুপ্ত মেধাকে জাগ্রত করতে পারেন। আর যদি সেই মেধাকে মনের মাধুরি মিশিয়ে সযত্নে চাষ করতে পারেন। তখনি কেবল আপনি মেধার শ্রেষ্ঠ চাষা। হতে পারেন জাতি গড়ার সুনিপুণ কারিগর। আপনিই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তৈরীর ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সক্ষম।
গুণগত, মানসম্মত ও যুগোপযোগী পাঠদানে, শিক্ষামুলক বিনোদনে আপনি পাকা অভিনেতা। যেহেতু নৈতিক শিক্ষা ও দেশ প্রেম ছাড়া সকল অর্জন অর্থহীন, সেহেতু জাতি গড়ার মহান কারিগর হিসেবে শিক্ষার্থীদেরকে সর্বাগ্রে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে ও দেশ প্রেমের গান শেখাতে আপনি সদা জাগ্রত। পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্রতার কষাঘাত, বৈষম্যের বেড়াজাল আর শিক্ষা পদ্ধতির জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে কাংখিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র শেখান আপনি। কেউ স্বপ্ন ভাঙ্গার শত কারণ দেখালে, আপনি স্বপ্ন পূরণের হাজারো প্রমাণ দেখিয়ে ঘুরে দাড়াবার গান শেখান। তাই আপনি হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বপ্ন পূরণের শ্রেষ্ঠ সারথি।
পাশাপাশি আপনার রয়েছে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা। অর্থনৈতিক ভাবে আপনি চরম বিপর্যস্ত। সমাজের কিছু নিকৃষ্ট রাঘব বোয়ল আর মাথামোটা জ্ঞান পাপীদের অসার উপদেশ ও অনর্থক জ্ঞানের বানী অপনাকে সযত্নে হজম করতে হয়। কাগজে-কলমে, কাব্যে-মহাকাব্যে, সাহিত্যের পরতে পরতে, বক্তৃতার ময়দানে, লোকদেখানো সব গানে-স্লোগানে কিংবা আলোচনার টেবিলে আপনার গুণগান ও মর্যাদা চর্চার কোনো অন্ত নেই। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় আপনি তার বিপরীত চিত্রের এক মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত। অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞান, উন্নয়ন আর উন্নত জীবন-যাপনে, চিন্তা-চেতনায় যে জাতিগোষ্ঠী সমৃদ্ধির শীর্ষে, তারা শিক্ষক ও শ্রমের সঠিক মুল্য দিয়েই তাদের ইতিহাসকে সমুজ্জ্বল করেছেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সেক্ষেত্র এখনো আপনাকে ভিন জতির উদাহরণ টেনে নিজের অধিকার ও সম্মানের স্লোগান ধরতে হয়। অধিকার বঞ্চনার নিরব বেদনার জলে রিক্ত আপনি। তারপরও এ নিয়ে আপনার যেন তেমন কোন ভাবনা নেই। নেই কোন দুঃখ। প্রদীপ যেমনি তার নিচে আধার ধারণ করে অন্যের আলোর তরে নিজেকে পুড়িয়েও কোন আক্ষেপ করেনা, তেমনি আপনিও করেন না। তবে কোন শিক্ষার্থী বিফল হলে, বিপদে পড়লে, বিপথে পা বাড়ালে কিংবা দেশ, জাতির ক্রান্তিকালে আপনি যেন কষ্টে নীল, মহা নীল।
অন্যদিকে আপনি সীমাহীন সান্তনায় পরিতৃপ্ত। আপনি সে পেশার সারথি যে পেশা থেকেই যে অন্য সকল পেশার সৃষ্টি। সেই সৃষ্টি সুখই যেন আপনার সেরা সান্তনা। গভীর মমতায় গড়া আপনার সৃষ্টির মাঝেই আপনি অমরত্বের পরমানন্দ উপভোগ করেন। অপনার মৃত্যু নেই। আপনার স্বপ্নের কোন পরাজয় নেই। আপনি স্বপ্ন জয়ের এক সুনিপুণ কারিগর।
আবদুল ওয়ারেছ
প্রভাষক (ইংরেজি)
হাজিরহাট হামিদিয়া কামিল মাদরাসা,
কমলনগর, লক্ষ্মীপুর।